সোজাসুজিই বলি, একজন মানুষকে ভালবাসি। খুব বেশী ভালো বাসতাম। কীভাবে
বললে বুঝবেন খুব, খুব এর গভীরতা কীভাবে বুঝাই?
সবাই বলে প্রেমিকার চোখে গভীরতা
থাকে, আমি নিজেকে আয়নায় দেখেছি ঘুরিয়ে
ফিরিয়ে, আমার চোখে কোনো গভীরতা নাই। চোখের পাপড়ি এলোমেলো,
চোখ দেখলে কেউ প্রেমে পড়ত না। তাহলে কীভাবে বুঝাই গভীরতা?
এতটাই গভীর ছিল সে অনুভূতিগুলো যে আমি কখনোই তাকে ছুঁতে পারতাম
না, যত ভাবতাম এই বুঝি ধরে ফেলেছি তার শব্দ, আওয়াজ- ঠিক তক্ষুনি সে চলে গেছে আরও আরও গভীরে, যেন একটা নোঙ্গর শিকল ছিঁড়ে ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রে। যখন প্রথম অমিতের
চোখের দিকে তাকাই, কিছুক্ষণ তাকিয়েই ছিলাম। ওর ভালোবাসা
যতটা গভীর ছিল, চোখ ততটাই সমতল ছিল। যেন গভীর থেকে উঠে
আসা ঢেউ এসে এখানেই মিলিয়ে যাচ্ছে, এই বেলাভূমিতে।
চোখ সম্পর্কে অমিত বলতো, ‘মানুষের চোখের গভীরতা এমন হতে পারে যে, সেখানে এসে নোঙ্গর করতে পারে এথেন্স-গামী বাণিজ্য জাহাজ।’
অমিতের চোখ অতটা গভীর নয়, তবুও তাকিয়েছিলাম অমিতের ভাসা ভাসা চোখের দিকে, ওর চোখের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও মুগ্ধকর বিষয় ছিল ওর চোখে যেন সবসময়য় এক
ফোটা জল এসে চিকচিক করত। যেন সূর্যের আলো এসে এইমাত্র পবিত্রতায় ভরিয়ে দিয়ে গেল
দুটি চোখ, এখন যা দেখবে সবই মনে হবে শুদ্ধ, সবই মনে হবে পবিত্র। পরে জেনেছিলাম, ওটা ওর
চোখের অসুখ। ওর চোখ দিয়ে প্রায়ই জল পড়ত। কি জানি ওর ঐ অসুখটাই আমার কাছে সুখের
কারণ হতে লাগলো।
ছেলেদের সাধারণত বেশী ফর্সা হতে
নেই, বেশী ফর্সা হলে কেমন একটা গাধা
টাইপের মনে হয়। অমিত ছিল এই গাধা লেভেল ফর্সার থেকে একটু উপরে। ওকে দেখে ঠিক গাধা
টাইপ ফর্সা মনে হয়ত না। তবে কখনো ভাবিনি কোনো ফর্সা ছেলের সাথে প্রেম করবো। এমনিতে
আমি নিজেই ফর্সা, তাই সবসময়েই একটু কালো ছেলেদের প্রতি
আকর্ষণ ছিল। কিন্তু ওর চোখদুটো দেখে দেখতেই থাকলাম! অমিতের সব রহস্য যেন সব ওর
চোখে। চোখের নিচ দিকটায় কালো কালো দাগ, ডার্ক সার্কেল।
কতদিন ঘুমায়-নি এই মানুষটা? এত রাত সে কেন জাগে? তার কি অনেক দুঃখ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতাম
ওর চোখে।
সত্যি বলতে ভালোবাসা, প্রেম এই শব্দগুলোর সাথে আমার কখনোই কোনো বিরোধ ছিল না।
আমার কাছে ভালোবাসা মানে খারাপ কিছু না। যখন যে আমাকে ভালবেসেছে আমিও তখন চেষ্টা
করেছি তাকে তার প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দিতে। ভালোবাসা একটা অদ্ভুত মাদকতা, অনেক প্রশ্নের উত্তর দেয় আপনা আপনিই। এমন কোনো মহৎ ভালোবাসার অপেক্ষায়
কখনো থাকিনি যা এসে আমাকে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়ে যাবে। মনে হত, জীবনে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য খেতে হয় ভালোবাসাও তেমন পেতে হয়, দিতে হয়। কখনো কখনো দুঃখ পেতে হয়, আবার দুঃখ
দিতেও হয়। হৃদয়ের এই দাবীকে কখনোই অস্বীকার করতে পারিনি।
অমিতের সাথে আমার প্রথম দেখা
হয়েছিল একটা খোলা রাস্তায়। এমন না যে সে’ই আমাদের প্রথম পরিচয়। পরিচয় হয়েছিল অনেক
আগেই। আমাদের কথা হত টেলিফোনে, চিঠিতে
ভাবের আদান প্রদান হয়ত। অমিত বলত, ‘ওর কোনো ভাব নেই,
আছে কেবল অভাব।’
অমিতের সবগুলো কথাকে আমি নোট করতাম, যেগুলো মনে হয়ত টুকে রাখা দরকার, টুকে রাখতাম। জন্মদিন, বিশেষ বিশেষ দিন তারিখ, বিশেষ বিশেষ মুহূর্ত সবকিছুই টুকে রাখতাম।
অমিতের সবগুলো কথাকে আমি নোট করতাম, যেগুলো মনে হয়ত টুকে রাখা দরকার, টুকে রাখতাম। জন্মদিন, বিশেষ বিশেষ দিন তারিখ, বিশেষ বিশেষ মুহূর্ত সবকিছুই টুকে রাখতাম।
রাস্তা থেকে আমরা চলে গেলাম
পাশেই একটা রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্ট সম্পর্কে অমিতের ধারণা তেমন ছিল না। আমারও
তেমন ভালো জানাশোনা কোনো রেস্তোরা ছিল না। তাই অমিত যেখানে নিয়ে যায় সেখানেই যাব
বলে স্থির করলাম। অমিত যা যা অর্ডার করবে সেগুলোই তৃপ্তি নিয়ে খাব, আমি আজ শুধু অমিতের কথা শুনব; মোটামুটি
কোনো অতিরিক্ত আশা রাখব না, কোনো প্রত্যাশা রাখব না- বাসা
থেকে বের হবার সময় এমনভাবেই নিজেকেই মাইন্ড সেটআপ করে বের হয়েছি। যদিও কথাবার্তায়,
চিঠিতে খুব ভদ্র ও মার্জিত, তবুও হয়ত
মানুষ চিঠিতে এক রকম আর বাস্তবিক আরেক রকম। অমিত’কে তাই বেশী মানবীয় ভাবতে ইচ্ছে
করছে না। অমিত’কে ভাবছি নিজের জানাশোনা মানুষদের দিয়েই। তাদের দিয়েই অমিতের
মানসিকতা মাপছি। অথচ চেয়েছিলাম কোনো মাপজোক করব না, একদম
বিচারবুদ্ধি সব বাসায় রেখে বের হব। কিন্তু পারছি কই?
রেস্টুরেন্টে যখন পৌঁছলাম, সন্ধ্যা প্রায় হবে হবে। অমিতের কাছে শুনেছি সন্ধ্যা
সময়টা বেশ পবিত্র। রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়ে সে কাচের দরজার হাতল ধরে দরজা খুলে,
আমাকে সম্ভাষণের মত করে হাত বাড়িয়ে কুর্নিশ করে আগে যেতে বইলো।
আমি ভেতরে যাওয়া মাত্র একটা টেবিল বেছে নিয়ে টেবিলের থেকে চেয়ারটা টেনে আমাকে বসতে
বললো। তারপর আমার থেকে সামনে গিয়ে চেয়ারের হাতল ধরে আমার দিকে তাকিয়ে বেশ নম্র
স্বরে জানতে চাইলো,
- মে আই হ্যাভ এ সিট?
আমি এই অদ্ভুত আতিথেয়তার কি উত্তর দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না, ফিক করে হেসে দিলাম।
- মে আই হ্যাভ এ সিট?
আমি এই অদ্ভুত আতিথেয়তার কি উত্তর দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না, ফিক করে হেসে দিলাম।
রেস্টুরেন্ট থেকে যখন বের হয়েছি, বাইরে তখন বেশ কম গাড়িঘোড়া। কেবল সন্ধ্যা হয়ে এসেছে
বলেই হয়ত সবাই যার যার মত ঘরে ছুটে গেছে, আর যার ঘর নেই
সে গেছে অপরের কাছে৷ আমার আর অমিত কারও কোনো তাড়া ছিল না। তুলনামূলক কম গাড়ি,
কম ট্রাফিক দেখে বেশ ভালোই লাগছিল। যেন গল্পের মত পরিবেশ।
উইকেন্ড বলেই হয়ত ফাঁকা ফাঁকা। হাঁটছি পাশাপাশি৷
পাশাপাশি হাটার কারণে অমিতকে
ভালোভাবে দেখা যাচ্ছে না, ইচ্ছে করেই দু’পা
পিছিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য ও’কে দেখে নেয়া। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা নয়, যতদূর দেখলে পরবর্তীতে ও’কে মনে রাখতে সুবিধে হয় ততটা। অমিত একটা
কালোমতো জামা পরেছে, সাথে হালকা জিন্সের প্যান্ট। পায়ে
কেজ্যুয়াল জুতো৷ জামা জুতো সবকিছুই একেকটা একেক রঙের। ভেবেচিন্তে পরেছে বলে মনে হয়
না। ভেবেছিলাম পাঞ্জাবী পরবে অন্তত! এতটুকু রোমান্টিসিজম সে দেখাতেই পারতো।
যেসব ছেলেদের বাড়ি পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান তারা তো সারাদিনই পাঞ্জাবী পরে থাকে। সেসব স্থানের নারীদের কাছে তাদের পুরুষগণ কি সবসময়েই রোমান্টিক? নয় নিশ্চয়! এসব ভাবতেই মনে হল পাঞ্জাবি না পরে আসাটা বোধহয় তাহলে তেমন কোন অপরাধ না, এবারের মত মাফ করে দেয়া হলো। কিন্তু আমি তো শাড়ি পরেছি, সেটাই হয়েছে অস্বস্তি।
যেসব ছেলেদের বাড়ি পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান তারা তো সারাদিনই পাঞ্জাবী পরে থাকে। সেসব স্থানের নারীদের কাছে তাদের পুরুষগণ কি সবসময়েই রোমান্টিক? নয় নিশ্চয়! এসব ভাবতেই মনে হল পাঞ্জাবি না পরে আসাটা বোধহয় তাহলে তেমন কোন অপরাধ না, এবারের মত মাফ করে দেয়া হলো। কিন্তু আমি তো শাড়ি পরেছি, সেটাই হয়েছে অস্বস্তি।
রেস্টুরেন্টে খাবারের মেন্যুটা
প্রথমে অমিত আমার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। তারপর নিজে অর্ডার করেছে। সি ফুড আমার পছন্দ।
ডেজার্টের মধ্যে কাস্টার্ড। এ-দুটোই দিলাম। অমিত শুধুমাত্র একটা কফি। আর যেচে আমার
জন্যও একটা কফি দিল, তাও আবার অনুমতি নিয়ে
তবে৷ সবচেয়ে বড় কাণ্ডটি করেছে বিল দেয়ার সময়। আমার হাতটা টেবিলের উপরেই ছিল,
ওয়েটার এসে বিল বুকটা রেখে যাওয়া মাত্রই ও’র বাম হাতে আমার ডান
হাতটা ঈষৎ চেপে ধরে বললে,
• এলাউ মি প্লিজ!
• এলাউ মি প্লিজ!
বলেই এমনভাবে তাকালো যেন চোখ
দিয়ে কিছু একটা চাইছে, করুন আকুতি সে
চাহনিতে। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছু মুহূর্তের জন্য নির্বাক হয়ে-গিয়েছিলাম।
অমিত হাত ধরবে সেটা যেন জানাই ছিল, কিন্তু ভাবতেই পারিনি এভাবে বিল দেবার বাহানায় হাত চেপে ধরবে। যখন হাতটা ছেড়ে দিলো, মৃদু একটা চাপ দিয়ে কী বুঝাতে চাইলো? ‘আমি আছি, নির্ভরতা!?
অমিত হাত ধরবে সেটা যেন জানাই ছিল, কিন্তু ভাবতেই পারিনি এভাবে বিল দেবার বাহানায় হাত চেপে ধরবে। যখন হাতটা ছেড়ে দিলো, মৃদু একটা চাপ দিয়ে কী বুঝাতে চাইলো? ‘আমি আছি, নির্ভরতা!?
কী জানি এমনও হতে পারে বেচারা
কিছু না বুঝেই হাত ধরে ফেলেছে। আমিই হয়ত ছয় লাইন বেশি ভেবে ফেলছি।
ফুটপাত ধরে হাঁটছি, সামনের পা’দুটো অমিতের, পেছনের
দু’টো আমার। কিছু কথাবার্তা হচ্ছে। এই যেমন,
• আজকের
আবহাওয়া বেশ গরম।
• বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই মনে হয়।
• সাবধানে হাঁটুন, দেখে।
• রাস্তা পার হই?
• বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা নেই মনে হয়।
• সাবধানে হাঁটুন, দেখে।
• রাস্তা পার হই?
রাস্তা ক্রস করলাম ফুট
ওভারব্রিজ দিয়ে। ওভারব্রিজে লাইটগুলো টিমটিমে৷ মৃদু আলোতে ইচ্ছে করছিলো ব্রিজের
উপরে দাড়িয়ে থাকি৷ মৃদু বাতাস আসিছিলো উত্তর থেকে। খুবই মিহি বাতাস। এই ধরনের
বাতাস’কে ইংরেজরা খুব কদর করে। আদর করে ওরা নাম দিয়েছে ‘জেন্টেল ব্রিজ’। কিন্তু
আমার যে এই স্টিলের ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে খুব জেন্টেল ব্রিজ খেতে ইচ্ছে করছিলো
সেকথা সাথে থাকা জেন্টলম্যানকে কিকরে বুঝাই! হঠাতই খেয়াল করলাম হাঁটার সময় আমি যে
ইচ্ছে করেই দু'পা পিছিয়ে গিয়েছিলাম
সেটা কেমন করে যেন এক লেভেলে এসে গেছে৷
রাস্তা পার হয়ে রিক্সা নিলাম।
নিলাম বলতে আমিই নিলাম। অমিতকে দিয়ে কিছু হবে না। সে হয়ত সারা রাত আমাকে রাস্তায়
হাঁটিয়েই রাখবে।
অমিতকে আমি কিভাবে কি মূল্যায়ন করব বুঝতে পারছি না। রিক্সা ডাকা মাত্রই সে এমনভাবে হাসি দিল যেন সেও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যেন সেও আর হাঁটতে চাইছিল না। তাহলে বাবা রিক্সা ডাকলে না কেন! এই গাধা-গিরির কোনো মানে হয়? যখন রিক্সায় উঠতে যাব, সে গিয়ে ঘুরে হাত ধরে সাহায্য করলো৷ শাড়ি পরে যে রিক্সায় ওঠা একটু ঝামেলার অমিত কী করে জানে সে কথা!
রিক্সা চলছে কোনদিকে কেউ জানি
না। অমিতকে মনে হলো বেশ চিন্তিত, কিছু সমস্যা?
জিজ্ঞেস করতেই উত্তর দিল,
• রাস্তাটা বেশ এবড়োখেবড়ো – শক্ত করে ধ’রে রাখবেন।
• রাস্তাটা বেশ এবড়োখেবড়ো – শক্ত করে ধ’রে রাখবেন।
আচ্ছা! এই চিন্তা তাহলে? অমিত কি আমাকে খুকি ভাবে? রিক্সা
থেকে পড়ে যাব? নিজেকে এতটা স্মার্ট ভাববার কি আছে!
পরক্ষণেই একটা স্পিড ব্রেকারের
সাথে একটু জোরেই ধাক্কা খেল রিক্সা, পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিয়ে ফিরে দেখি অমিত অতি ইতস্ততভাবে আমার হাত
ধরে আছে। মনে মনে হেসে নিলাম। একটু গুছিয়ে বসে এবার অমিতের দিকে তাকালাম। এবার
নিজেই অমিতের হাতটা টেনে ওর আঙ্গুলগুলোর সাথে আমার আঙুলগুলো জড়িয়ে বললাম,
• দেখবেন, যেন আবার পড়ে না যাই।
• দেখবেন, যেন আবার পড়ে না যাই।
রিক্সা এগিয়ে চললো। অমিতের সাথে রিক্সায় চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমার চেনাজানা শহরে। এই রাস্তা, এই বাতিগুলো সবই আমার চেনা। তবুও যেন মনে হচ্ছে সবকিছু অচেনা। যেন অচেনা পথে সামনের মোড়টা পার হয়ে কী আসবে দোকান না সিনেমা হল সেটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে এগুচ্ছি।রিক্সায় আর কারও কোনো কথা হলো না। যেন কথা হচ্ছে সব মনে মনে ইথারে ইথারে। পাশাপাশি হাত ধরে বসে এভাবে চুপচাপ থাকাকে কি বলব? মৌন দ্যোতনা? নাকি গভীরতা? নাকি যাতনা! রিক্সা এসে থামল ঈদগা মাঠের কোনায়। রোজা প্রায় শেষ হয়ে আসছে। লাইট জ্বালিয়ে ঈদগা তৈরির প্রস্তুতি চলছে। রিক্সা থেকে নেমে অমিত নীরবতা ভাঙল।
বলল
,• আপনার কি ঘরে ফেরার তাড়া আছে?
সন্ধ্যা অনেক আগেই শেষ হয়েছে। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অমিত’ই বলল,
• ন’টা কুড়ি৷
ঘরে ফেরার তাড়া যে নেই তা নয়।
দেরী করে ফিরলেও সমস্যা কিছু হবে না। দুইটা বড় বড় অজুহাত প্রস্তুত করাই আছে। তবুও
পালটা প্রশ্ন করলাম,
• তাড়া থাকলে কী করবেন?
• তাড়া থাকলে কী করবেন?
সময় ও আবেগের গ্রাভিটি কাটিয়ে
উঠে অমিত কোনো উত্তর দিতে পারলো না। একটু দূরত্বে দাঁড়িয়েছিলাম, এবার অমিত দু’পা সামনে এগিয়ে
আসলো। অমিত আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, কী বলতে চাইছে সে?
আমি কি সত্যিই জানি না কী বলার থাকতে পারে অমিতের! তবুও কেন
ইচ্ছে হচ্ছে নিজের মুখের বলুক সে। নিজেকে সে প্রকাশ করুক। মুহূর্তের পর মুহূর্ত
অমিত নিবিড়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। দাঁড়িয়ে রইলাম
আমিও।
ভালোবাসা শব্দটিকে আজকাল এত
তাচ্ছিল্য-ভরে দেখা হয়, যেন এর থেকে হাস্যকর
শব্দ বাংলা ভাষায় আর নেই। অমিত সেই হাসির পাত্র হতে চাইলো না কেন? সে কেন বলল না, ‘ভালোবাসি’।
অমিত এবং আমার দুজনেরই মূলত একই
সমস্যা, দুজনেই ভাবছি আমরা অন্যদের থেকে
আলাদা, একটু মৌলিকত্ব আছে দুজনের মধ্যেই। কথাটা একেবারেও
মিথ্যে নয়। তাই বলে সর্বসাধারণের সাথে মিশে যাওয়া যাবে না এমন কোনো বৈরিতাও তো নেই
আমাদের অন্যদের সাথে। মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম, অমিত যদি
ভালোবাসার কথা জানায় জিজ্ঞেস করবো,
কেন ভালোবাসে?
কেন ভালোবাসে?
আজ পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তর
কেউ দিতে পারে নাই। কেউ কেউ বলে মানুষ অন্যকে ভালোবাসে নিজেকে ভালোবাসে বলে, কেউ বলে নিজে ভালো থাকবে বলে অন্যকে ভালোবাসে। কেউ বলে
একজন অন্যকে ছাড়া সম্পূর্ণ নয়, তাই ভালোবাসা। সত্যি বলতে
আমিও জানি না এর সঠিক জবাব কী হতে পারে? সত্যিই, কেন একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে ভালোবাসে। মানুষ কি সত্যিই পারে
ভালোবাসোতে? সেটা কী আবেগ নয়? মোহ
নয়—নেশা নয়? যদি ধরেও নেই একজন মানুষ সত্যি সত্যিই
ভালোবেসে ফেলেছে আরেকজনকে, তাহলেও বা কে দেবে এই জবাব,
কেন সে বেসেছে ভালো!
অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও অমিত কিছু বলছে না দেখে আমিই বলে ফেললাম,
– অমিত, কেন আমাকে ভালোবাসো?
অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও অমিত কিছু বলছে না দেখে আমিই বলে ফেললাম,
– অমিত, কেন আমাকে ভালোবাসো?
অমিতের চোখমুখ দেখে মনে হলো না
যে সে এই প্রশ্ন শুনে বিস্মিত হয়েছে। এত কনফিডেন্স মানুষ কোথায় থেকে পায়? উলটো কি আমিই অবাক হচ্ছি, বিস্মিত
হচ্ছি অমিতের এই নির্লিপ্ত ভাব দেখে! অথচ আমার তো কোনোকিছুতেই বিস্মিত হবার কথা
ছিল না। আজ সেভাবেই মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে বের হয়েছি।
অমিত এই প্রশ্নের যে উত্তর দিলো
যার বিষয়বস্তু এই যে,
‘ভালোবাসাকে একটা বইএর সাথে সাথে তুলনা করলে মনে হয় একটু স্পষ্ট হয়। একটা বই যখন পড়া শেষ হয়, এবং যখন মনে হয় লেখক আমার কথাগুলোই বলেছেন, তিনি আমার হয়েই লিখেছেন- তার পুরো বইটা পড়তে পড়তে যখন একই ধরনের চিন্তা হতে থাকে তখন সে’ই বইটিকে ভালোবেসে ফেলা যায়। লেখক’কেও ভালোবেসে ফেলা যায় তবে সেটা অতটা প্রকট নয়। এই যে বইএর মধ্যে আমাকে খুঁজে পেলাম, এই আমি’টা খুঁজে পাওয়াকেই মনে হয় ভালোবাসা। কেউ যদি কারও মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায় সেটাই ভালোবাসা।’
‘ভালোবাসাকে একটা বইএর সাথে সাথে তুলনা করলে মনে হয় একটু স্পষ্ট হয়। একটা বই যখন পড়া শেষ হয়, এবং যখন মনে হয় লেখক আমার কথাগুলোই বলেছেন, তিনি আমার হয়েই লিখেছেন- তার পুরো বইটা পড়তে পড়তে যখন একই ধরনের চিন্তা হতে থাকে তখন সে’ই বইটিকে ভালোবেসে ফেলা যায়। লেখক’কেও ভালোবেসে ফেলা যায় তবে সেটা অতটা প্রকট নয়। এই যে বইএর মধ্যে আমাকে খুঁজে পেলাম, এই আমি’টা খুঁজে পাওয়াকেই মনে হয় ভালোবাসা। কেউ যদি কারও মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায় সেটাই ভালোবাসা।’
কথাটা ঠিক কিছুটা, একজন অন্যকে ছাড়া সম্পূর্ণ নয়; এমনটা মনে হলেও কিছুটা যেন আলাদা, কোথায় যেন
একটু বৈচিত্রতা আছে। যাক! একটা অন্যরকম উত্তর তো পাওয়া গেল অমিতের থেকে। এই বা কম
কিসে!
রাত বেড়ে যাচ্ছে, আমাকে সত্যিই এবার ঘরে ফিরতে হবে। অমিতকেও ফিরতে হবে
অনেক দূরে। আমার সাথে ঘুরতে ঘুরতে বেচারা অনেক দূরে চলে এসেছে। বিদায় কীভাবে নেব
এসব চিন্তা করতে করতেই হঠাত অমিত বলল,
– ফ্লোরা, একটা জায়গায় যাবেন !
– ফ্লোরা, একটা জায়গায় যাবেন !
পুরোটা দিন শেষে এই প্রথম অমিত
আমার নাম ধরে ডাকল, ওর মুখে নিজের নাম
শুনে একটা হার্ট-বিট যেন মিস হয়ে গেল। নিজেকে সামলে বললাম,
– কোথায়?
– কোথায়?
আমার দিকে তাকিয়ে অমিত এমনভাবে
হাসল যেন, নিশ্চিত না হয়ে যাওয়া যাবে না কোথাও!
আগে থেকেই ঠিকানা যেনে নিতে হবে; কে বলবে এ ছেলে ছেলেধরা
নয়!
অমিতের এমন হাসি দেখে, আমিও হেসে দিলাম। ভুলে গেলাম বাড়ি ফেরার কথা। অমিতের
সাথে যেতে থাকলাম কিছুটা দূরে, আরও কিছুটা দূরে— তখনো
জানি না কোন জায়গায় যাচ্ছি আমি, কোথায় আমাকে নিয়ে যাচ্ছে
অমিত!
0 comments: