Saturday, September 21, 2019

কবিতার কথা ----



কবিতা সবার পড়ার দরকার নাই। আমি অনেককে চিনি জানি যারা স্কুলের বই ছাড়া আর কোন কবিতা পড়েন নাই এবং তারা দিব্যি ভালো আছেন। আমার থেকে ভালো আছেন।
তাই, সকলের কবিতা পড়ার দরকার নাই। সাধারণ পাঠকের কোন দায় ও দরকার নাই কবিতা পড়বার। কবিতার যে অত গভীরতা সেটা আর কে বুঝবে কবি ছাড়া। সত্যি কথা বলতে, আমি কিছু কিছু কবিতা সাধারণ পাঠকের জন্য লিখি না। কেবল কবিদের জন্যই লিখি।
আমার তো মনে হয়, যিনি কবিতা লিখেন একমাত্র তিনিই কবি নন, যিনি কবিতা পড়তে জানেন তিনিও কবি। সবাই কবিতা পড়তেও জানেন না, জানবার কথাও নয়।
কবিতার মধ্যে বিষণ্ণতা থাকে, কিন্তু যখন আমি লিখছি তখন আমার মন ভালো থাকে। কবিতার এই দ্বি-মুখী আচরণটা তো একজন সাধারণ বা গণ পাঠক ধরতে পারবেন না। ধরতে পারার কথাও না।
রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার কয়েকটা লাইন পড়ার পরে আমার যদি মনে হয় এই বিচ্ছেদটা আমার, কবি আমার জন্যই লিখেছেন; তাহলে সেটা পাঠ করে আমি আমার তৃপ্তি টুকোই কেবল পাব। কবি যে সত্ত্বা থেকে লিখেছেন সেটা পাব না। সেটা পেতে হলে আমাকে কবিতার মধ্যে ঢুকে যেতে হবে, কবিতার শব্দ অক্ষর অলিগলি ঘুরে পৌঁছে যেতে হবে রবীন্দ্রনাথের বেডরুমে। লাবণ্যকে বিদায় জানিয়েছে অমিত, কিন্তু সেই অমিতকে ধারণ করতে কবির যে কষ্টটা হচ্ছে সেটা অনুভব করতে হবে।
ডেসডিমোনাকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যার পরে ওথেলো তো আত্মহত্যা করে মুক্তি পেয়ে গেল কিন্তু দুই দুইটা খুন করে শেকসপিয়রের যে অপরাধ-বোধ নেই সেটা কে বলবে? সেই যন্ত্রণাটা অনুভব করতে হবে না?
প্রেমের কবিতা যিনি লিখেন তিনি নিজে কতটা অপ্রেমে আছেন সেটা আগে অনুভব করতে হবে,
ক্ষুধার কাব্য যিনি লিখেন তিনি নিজে কতদিন না খেয়ে থেকেছেন, কত রাত তিনি নিজে জল খেয়ে কাটিয়েছেন সেটাও জেনে নিতে হবে।
সাহিত্যিকের সাহিত্য বিচার প্রকাশিত নথি বা বই দিয়ে করা হলেও লেখকের ব্যক্তিগত জীবনকে উপেক্ষা করা একেবারেই উচিত নয়।
সবাই যদি বলেন যে,
কবির ব্যক্তিগত জীবন অচ্ছুত অস্পৃশ্য; ওটা ছোঁয়া যাবে না– তাহলে ঐ বেচারা কবিকে মরতে হবে না খেয়ে, প্রেমের কবিতা লিখতে হবে অপ্রেম করে।
মৃত্যুর পরে ব্যবচ্ছেদ করলে করবেন; আপনাদের কৃপা।
রবীন্দ্রনাথ এত যে প্রেমের গান লিখেছেন তিনি নিজে কতটা প্রেম পেয়েছেন সেটাও ভেবে দেখতে হবে। কিংবা তিনি এই যে এত প্রেম পেয়েছেন, সেগুলো সত্যিই কি প্রেম? ঠিক তিনি যে রকম প্রেম চেয়েছেন সেই রকম প্রেম? মনে তো হয় না। পেলে আর এত কেন লিখবেন? যেটা পাওয়া যায় না সেটাই চাওয়া হয় কবিতায়, গানে, নাটকে, সংলাপে, প্রলাপে।
বলা হয়ে থাকে যে, বাংলা গানে রবীন্দ্রনাথ একই সাথে সর্বস্ব ও সর্বনাশ।
সর্বনাশের মাথায় বাড়ি দেয়ার আগে অবশ্যই অবশ্যই ভাবতে হবে সর্বনাশটা যে হলো, কেন হলো? এত আকুতি আর কারও গানে নেই কেন? রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল-সংগীত, লালনগীতি এরপরে আমরা আর কোন গীতির নাম শুনি না কেন?
আমাদের চাহিদা কি তবে মিটে গেছে? কে মিটিয়ে দিয়ে গেল?
আমার দেখা দশ জন কবির মধ্যে আট জন কবিতা লিখতে চান না। তারা এককথায় শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে লিখেন। এবং সেগুলো গার্বেজ ছাড়া আর কিছুই না।
এইবার, কবির কথা বাদ দিলে আমাদের কথা অর্থাৎ পাঠকের কথা ভাবতে হয়।
পাঠক কারা? যারা পড়েন তারা সবাই কি পাঠক?
যিনি দুই-চারটা কবিতা লিখে ফেললেন তিনিই কি কবি? হাজার হাজার কবিতা লিখে রেকর্ড করতে পারলেই কি তিনি কবি?
ধরুন, কোন একটা কারণে আপনার মনটা বেশ ভারী হয়ে আছে। একটা খাতা কলম টেনে কয়েকটা লাইন লিখলেন। তারপর আপনার মনে হলও যে, “নাহ ! খারাপ হয়নি”।
খারাপ যে হয়নি সেটা তো আপনিই বুঝলেন, কিন্তু কি হয়েছে সেটা কি জানেন? আপনি কি এটাকে কবিতা বলেই ভেবে নিয়েছেন? যদি ভেবে নিয়ে থাকেন, তাহলে আপনার এই কবিতার পাঠক হবে তারাই যারা ঐভাবেই নিজেদের পাঠক ভাবেন।
আজকাল এই যত্রতত্র কবি গজিয়ে ওঠার দায় আর কারও নয়, কেবল ও একমাত্র পাঠকের।
কবিতা তো আসলে চাইলেই কেউ লিখে ফেলতে পারে না, সেটা একটা নিজস্ব কিছু, নিজের মধ্যে ধারণ করার মত।
সবাই প্রেম করছে – প্রেমিকার হাত ধরে ঘুরছে, তাহলে আমারও একটা প্রেম করা দরকার; এটা ভাবনা নিয়ে কাউকে ভালোবাসার কথা বললে সেটা যেমন শুধু অপ্রেমই হবে ভালোবাসা হবে না, তেমনি সবাই লিখেছে বলে আমিও লিখব এবং খারাপ তো লিখছি না, এটা ভেবে লিখলে আসলে সেটা সত্যিই হিজিবিজি ছাড়া আর কিছুই হবে না।
ভালো যেমন সবাই বাসতে পারে না, দুই একজন পারে। বাকীরা রিলেশনশিপ করে। তেমনি কবিতাও সবাই লিখতে পারেন না, এক আধজন পারেন বাকীরা খিস্তিখেউড় করেন।
কবিতা কেন লিখতে হয়, কিভাবে লিখতে হয়, কতটুকু লিখতে হয় এসব যেমন ভাববার কোনো বিষয় নয়, তেমনি না ভেবেও লেখা উচিত না। আপনি আপনার কবিতার আয়ু কতটা চান সেটা আপনার ফুসফুসের দমের উপরেই নির্ভর করে।
আপনারা লেখেন, আপনাদের লেখাগুলো পড়ি। ভালো লাগলে জানাই। ভালো না লাগলেও মাঝেমধ্যে জানাই।
আপনারাও আমার লেখা পড়েন, ভালো লাগলে হাতে তালি দেন, খারাপ লাগলেও জানান। সার্কাসের জোকার না হয়ে আর থাকতে পারলাম কই?
(২১/৯/১৮)

SHARE THIS

0 comments: