মৃত্যু শব্দটিকে নিয়ে মানুষ ও ঈশ্বর
দু’জনেই এত বেশী বালখিল্যপণা করেছে যে মানুষ আর এখন মরতে ভয় পায় না। মৃত্যুর মত
এরকম আরও একটা শব্দ আছে, “ভালোবাসা”। ভালোবাসাকেও আজকাল সবাই এড়িয়ে চলে, যেন সেটা এমন একটা কিছু যা ছিল, শুনেছি অনেক আগে--- এখন বিলুপ্ত।
শুনতে ভালো লাগে কেউ কাউকে ভালোবাসে, অথচ নিজের সেই হিম্মত নেই পরখ করে দেখবার! তাই, আজকে দু’টি শব্দ’কে স্বেচ্ছায় এড়িয়ে
চলছি---
প্রিয় কবি সাহিত্যিক ও বোদ্ধাগণ,
আপনাদের অনেকের লেখা আমার ভালো লাগে
না। ভালো লাগে না মানে এই নয় যে আপনাদের লেখার সাথে আমার মতের ঐক্য নেই; আমরা নিশ্চয়ই সম্মিলিত ঐক্যজোট করতে
আসিনি।
একজন কবি’র জীবন অতটা কাব্যিক নয়; অথচ কবিতার নামে আপনারা কেউ কেউ যে
দাঁত ভাঙ্গা এবং হৃদয়-ভাঙা নেতানো মুড়ির ঠোঙা লিখে যাচ্ছেন, সেসব আমার বড্ড অপছন্দ।
ক্ষমা করবেন, আমি বিপ্লবী হতে পারিনি বলে, সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকি। কিছু একটা ভয়
আমাকে তাড়া করে বেড়ায় রোজ রাত্রে, সকালে, বিকালে। বিপ্লব আমি করতে পারিনি। তবে, দেখেছি কোনো বিপ্লবী মারা গেলে তার
পোষ্টার ছাপানো হয়, সেখানে তার সাদাকালো ছবি থাকে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা থাকে, তারপর দুপুরটা গড়িয়ে দেলেই কুকুর
গিয়ে পোস্টারের সামনে সঙ্গম করে। শুনেছি, তাদের শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থার এজেন্ডার কথা; বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা আমিও পেতে
চেয়েছি, অথচ বিপ্লব করার জন্য আমার পকেটেও কোনো টাকা ছিল না।
প্রিয় কবি সমাজ,
আপনারা কীভাবে সমাজবদ্ধ হয়ে উঠলেন? এরিস্টটল পড়েছেন বলে? পশু না হয় না’ই হতেন, দেবতাও তো হতে পারতেন! অথচ আপনারা
সাহিত্য সংঘ করলেন, সাহিত্য সমাজ করলেন! আপনাদের এই মেলবন্ধন কীভাবে হলো আর আমি’ই বা কীভাবে এর
বাইরে রয়ে গেলাম!
আমি মূলত প্রেমের কবি, প্রেম ছাড়া কোথাও কিছু দেখি না।
দেশপ্রেম, মানব-প্রেম, প্রেমিকার প্রেম, আত্ম-প্রেম--- এরকম কয়েক হাজার প্রেমের প্রেমিকা আমি। যে ‘পরম’ থেকে প্রেমের
সৃষ্টি; সে সত্তার প্রেমিক আমি; কবিতা কেবল’ই বহিঃপ্রকাশ!
প্রিয় বন্ধু,
বন্ধু’র কথা উঠলে আমি শত্রু খুঁজে
পাই না, কখনো কাউকে শত্রুর মত পাইনি। সবাই যেন কীভাবে কীভাবে এসে বন্ধু হয়ে গেছে।
শত্রু হতে গেলে যতটা যোগ্যতা লাগে বন্ধু তাতটাই সহজে হয়ে যাওয়া যায়। কাকে শত্রু
ভাববো? প্রিয় বন্ধু, তুমি আমার শত্রু হবে? এই প্রপোজাল নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি
বন্ধুত্বের দ্বারে দ্বারে—কেউ শত্রুত্ব গ্রহণ করেনি।
প্রিয় দেশ, প্রিয় স্বদেশ--
তুমি স্বাধীন, তুমি সেই নারীর মত স্বাধীন; যে নিজেকে পেঁচিয়ে রাখে শাড়ির ভেতরে।
তুমিও নিজেকে বেঁধে রেখেছ কাঁটাতারে। তোমাকে ভালোবেসেছি প্রেমিকার চাইতেও বেশী, প্রেমিকার অবহেলা তাও সওয়া যায়, রাষ্ট্রের নয়।
একটি রাষ্ট্রীয় আদেশের অপেক্ষায় আমি
জেগে ছিলাম সারারাত, সারা মাস – সারা বছর, এমনকি আমি জেগে ছিলাম সারা জীবন। শেষ পর্যন্ত
বেসরকারি মানুষ বলেই ফিরে যেতে হল।
প্রিয়তমা প্রেমিকা আমার,
আপনাকে দেখে এসেছি দেবীর মত। মত বললে
ভুল হবে, দেবী’কে দেখেছি আপনার মত। প্রেমিকার পায়ে চুমু খেতে চেয়েছি জলের মত। ভালোবেসে
নিষিদ্ধ শব্দগুলো বৈধ করতে চেয়েছি, অসম্ভবকে চেয়েছি সম্ভব করতে; অথচ কেউ আমাকে ভালোবাসা তো দূরের কথা
অবহেলা পর্যন্ত দেয়নি।
প্রিয় শিল্পী- চিত্রকর,
বহু দিনের ইচ্ছে কেউ আমার একটা ছবি
আঁকুক, যেখানে আমি
নিজেকে দেখতে পাব। ছবির গভীর মাহাত্ম্য আমি বুঝি না, রঙ এর খেলা বুঝি না। আমাকে একটা ছবি এঁকে দিও-
ঠিক যেমন আমাকে ভাবো তুমি। আমার চুলগুলো পেকে গেলে সাদা না হয়ে আমের মত হলুদ হয়ে
যাক, আমার ভালোবাসাকে
কষ্টের মত নীল না দেখে, সাদা দিয়ে শুভ্রতায় এঁকো। আমার প্রাপ্তবয়স্কতা দেখাতে গিয়ে আমাকে নগ্ন করে
ফেলো না যেন, আমি যৌনতাকে অবাধ ভাবি, শিল্পকে প্রাপ্তবয়স্ক ভাবি--- কেবল নিজের কাপড়
কেউ টান দিয়ে খুলে ফেলছে; কল্পনাও করতে পারি না।
প্রিয় সুরকার- গায়ক,
আমার আফসোস হয়, নিজেকে তুচ্ছ মনে হয়; সংগীতের মত এত ধ্রুপদী একটা শিল্প
আমি আত্মস্থ করতে পারিনি বলে। গানের কথা আমি আঊরে দেখেছি—সুর গুণগুনিয়ে
দেখেছি—আমার গলায় কোনো সুর নেই। আমার আঙুলে বাঁশি বাজে না, আমি ঠোঁট দিয়ে বাঁশিতে বাতাস ভরে দিতে
পারি না, আমার ফুসফুসে দম নেই---- নিজেকে বড্ড তুচ্ছ মনে হয়।
আমার একটা গানে সুর দিয়ে গেয়ে দিবে
কেউ? নিচু
স্বরে—কাহারবা, দাদরা, ভৈরবী—মালশ্রী—
যে কোনো রাগে—অনুরাগে!
যে কোনো রাগে—অনুরাগে!
প্রিয় আবৃত্তিকার,
কতটা অসহায় লাগে নিজেকে আপনাকে বুঝাই
কী করে? ইচ্ছে করে নিজের হাত আমি নিজে চিবিয়ে খাই, আমার লেখা কবিতা আমি পাঠ করতে পারি না! আমি গলায়
কম্পন উঠিয়ে, স্পন্দন তুলে ভাব ও ভাষার প্রয়োগ ঘটাতে পারি না। আমাকে দ্বারস্থ হতে হয় একজন
আবৃত্তিকারের! তার মুখে যখন আমার কবিতা শুনি--- নিজেকে বোবা মনে হয়। ঈশ্বরের কাছে
প্রার্থনা জানাই মনে মনে, ‘আমাকে কথা বলার শক্তি দাও’- ‘আমাকে বলতে দাও’, ‘আমার বাকযন্ত্রে সক্রিয়তা দাও’!
প্রিয় ধার্মিক এবং অধার্মিক,
মূলত আমরা ঘুরে ফিরে একই সত্তা ধারণ
করি। একজন এমন কাউকে বিশ্বাস করি, সর্বশক্তিমান ভেবে নিজেকে সমর্পণ করি যা’কে কখনো
দেখিনি, জানিনি। অন্যজন এমন কাউকে মানি না যাকে জানিও না। পার্থক্য কিছুই দেখি না।
আমি সেই জীবন ধারণ করি যেখানে কিছু
একটা অস্তিত্ব টের পাই, যেখানে নাড়ীর স্পন্দন আছে। আমার ধর্ম আমার অস্তিত্বে, আমার আচরণে আমার মানবিকতায়,
মানসিকতায়। আমার ঘরে বাইবেল, কুরআন, গীতা, ত্রিপিটক নেই; আমি মানুষের চোখে তাকিয়ে পড়ে নেই ঐশিবানী।
প্রিয় প্রকাশক,
সবচেয়ে গুরুতর দায়িত্ব আপনার; আমাকে প্রকাশ করবেন নাকি অপ্রকাশিত
রাখবেন সে দায় আপনার কাঁধে। আমি চাইব এই অছিয়তনামা আমার মৃত্যুর পরেই প্রকাশ পাক।
যদি মনে হয় আজ এখুনি এই লেখা প্রকাশ করতে হবে, তবে জেনে নিব এখন এই মাত্রই আমার মৃত্যু হলো। যদি
মনে হয় এই লেখা প্রকাশ অযোগ্য, তবে যেন কখনোই আমার মৃত্যু না হয়।
জাহিদ অনিক
কবি ও ব্লগার
0 comments: