Wednesday, February 26, 2020

শবনম - পুস্তক পর্যালোচনা

 
 
সৈয়দ মুজতবা আলী, নাম শুনলেই যাদের চোখের সামনে ভেসে আসে রসগোল্লা গল্পের ঝান্ডু দা’র কথা, শার্টের কলার ধরে একটি রসগোল্লা নাকের কাছে নিয়ে বলছে, ও পারণ খাবি নে? তোর গুষ্ঠি খাবে। তাদের ভাবনা-চিন্তায় একটু না অনেকখানি আমল পরিবর্তন এনে দিবে শবনম।
আমাদের উপমহাদেশীয় সাহিত্যে একটা মাপ কাঠি আছে, কিসের ভিত্তিতে সে মাপকাঠি ধরা হয় জানি না। তবে সাহিত্যিকদের কেউই বোধহয় সেই তুলাদণ্ড থেকে বাদ যায় নি। কোন লেখক যদি একবার রম্য গল্প লিখে বিখ্যাত হয়ে গিয়ে একটা প্রেমের গল্প লিখে থাকেন পাঠক তখন বলেন, “ওরে বাবা তিনিও রম্যের পাশাপাশি প্রেমটাও বেশ ভাল লিখতে পারেন”। কিছুতেই তাকে সেই সম্মানটা দেয়া হয় না যেটা দেয়া হয় অন্য কোন প্রেমের গল্প লেখা লেখককে।
যার কথা বলছিলাম বা বলতে চাচ্ছিলাম তিনি আর কেউ না, তিনি সৈয়দ মুজতবা আলী। যাকে আমরা সবাই একনামে চিনি রম্য লেখক হিসেবে। তিনিই যে একখানা আস্ত প্রেম-বিরহের উপন্যাস লিখে ফেলবেন এবং সে লেখা যে এতটা ভাল হবে তা কেউ আশা করেছিল কিনা জানি না, আমি অন্তত কিছুটা অবাক হয়েছি।
শবনম উপন্যাস সম্পর্কে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন “বাঙ্গালী তরুন-তরুনীদের প্রেমে পড়ার পূর্বে অবশ্যই সৈয়দ মুজতবা আলীর শবনম উপন্যাসটি পড়ে নেয়া উচিত। এমন শিক্ষণীয় প্রেমের উপন্যাস বিশ্ব সাহিত্যে আর একটিও নেই।” কথাটির সত্য মিথ্যা বিচার পাওয়া যাবে গোটা উপন্যাসটি পড়ার পরেই।
এই উপন্যাসের ভূমিকা লিখেছেন মুহম্মদ এনামুল হক এবং উৎসর্গ করা হয়েছে রাজশেখর বসুকে।

 
শবনমঃ প্লট ও পর্যালোচনা
আফগানিস্তান। সময়টা বাদশা আমানুল্লাহর শাসনামল। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পাগমান শহরে আয়োজন করা হয়েছে নৈশ বল-ডান্সের। সেই বেলেল্লাপনা বল ডান্স দেখতে যাওয়া এক তরুণীর সাথেই প্রেম হয়ে যায় পরদেশী এক তরুণের। তরুণ সে দেশে একেবারেই নতুন। গিয়েছেন হিন্দুস্তান থেকে অধ্যাপনা করতে। তরুণ অধ্যাপক যার প্রেমে পড়লেন তিনি যে সে দেশেরই রাজকুমারী সেকথা মনের ভুলেও ভাবেন নি ভিনদেশী যুবক। ভাবলেও সে ভাবনাকে পাত্তা দেয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। প্রেম কি এতসব ভেবে হয়? হয়েছে কখনও?
যে দুইটা চরিত্রের কথা বলছিলাম তাদের মধ্যে স্ত্রী চরিত্রটির নাম শবনম, বয়স আঠারো-উনিশ। কিন্তু উপন্যাসে তার সংলাপ পড়ে মাঝেমধ্যে মনে হয়ে তার বয়স হয়ত ৩৫, কখনও মনে হয়েছে তার বয়স ১৬ কিংবা ১৭। পুরুষ চরিত্রটির নাম মজনূন। বাংলা আর ইংরেজি ভাল জানেন কিন্তু ফার্সী ও ফ্রেঞ্চ খুব একটা পারেন না ভালো।
একে অন্যের নাম পরিচয় জানার এক মুহূর্তে মজনূনের ফার্সী ও ফ্রেঞ্চ সম্পর্কে শবনম রহস্য করে বলেছে,
আপনার ফ্রেঞ্চ অদ্ভুত, আপনার ফার্সীও অদ্ভুত। অদ্ভুত মানে খারাপ? ফার্সী উচ্চারণে কেমন যেন পুরনো আতরের গন্ধ, ঠাকুরমা সিন্দুক খুললে যেরকম বহু দিনের জমানো মিষ্টি গন্ধ বের হয় সেরকম। অন্য হিন্দুস্তানীরা যেরকম ভোঁতা ভোঁতা ফার্সী বলে সেরকম নয়” ।
সৈয়দ মুজতবা আলী শবনমের বর্ণনা লিখেছে এভাবে,
প্রথমে দেখেছিলুম কপালটি। যেন তৃতীয়ার ক্ষীণচন্দ্র। শুধু, চাঁদ হয় চাপা বর্ণের, এর কপালটি একদম পাগমান পাহাড়ের বরফের মতই ধবধবে সাদা। সেটি আপনি দেখেন নি? অতএব বলব নির্জলা দুধের মত। সেও তো আপনি দেখেন নি। তা হলে বলি বন-মল্লিকার পাপড়ির মত। নাকটি যেন ছোট বাঁশী। ওইটুকুন বাঁশীতে কি করে দুটো ফুটো হয় জানি না। নাকের ডগা আবার অল্প অল্প কাঁপছে। গাল দুটি কাবুলেরই পাকা আপেলের মত।
আফগানিস্তানে লেবু তেমন হয় না। প্রণয়ের প্রথম দিকে মজনূন শবনমকে উপহার দিয়েছিল পাঞ্জাবীর পকেট হাতড়ে পাওয়া একটি ভারতীয় লেবু।
লেবুটি পেয়ে শবনম বলেছিল,
এটা কি ? ওঃ ! নেবু? লীমূন । লীমূন-ই-হিন্দুস্তান যার ভেতরেরটা টক!
সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লেখক লিখেছেন,
ওরে মূর্খ! দিলি একটা নেবু! তাও শুনতে হল ভিতরটা টক! না, সে মীন করে নি। আলবাৎ করেছে। না।


শবনম। শবনম মানে তো শিশিরবিন্দু, হিমকণা। সে তো শিউলি। শরৎ-নিশির স্বপ্ন-প্রভাতের বিচ্ছেদ বেদনা। সে যখন ভোরবেলা সর্ব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়, সে কি স্বেচ্ছায়?
উপন্যাসের সবথেকে আকর্ষণীয় অংশ মনে হয়েছে নানা ফরাসি ও ফ্রেঞ্চ কবিতার অনুবাদ। শবনম ও মজনূন অনেক কথা বলেছেন কবিতায় কবিতায়। এই উপন্যাসে যথেষ্ট কাব্যিক ও ভাষা-তাত্ত্বিক মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। অসংখ্য ঘটনা, ভীতি, শিহরণ ও কাব্যিক ব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে আগাতে থাকে উপন্যাস শবনম। এক পর্যায়ে মজনূনের কুড়ে ঘরে নিয়মিত আসা যাওয়া চলতে থাকে শবনম বানুর। কখনও দিনের আলোয় বোরখায় নিজেকে ঢেকে, কখনও রাতের আঁধারে।
বোরখা সম্পর্কে শবনমের স্পষ্ট কথা, লোকে বলে বোরখা নারীদের বন্দি করে রেখেছে, আমি তো দেখি বোরখা নারীর সুবিধের জন্যই, ইচ্ছে করলেই নিজেকে লুকিয়ে ফেলা যায় বোরখার আড়ালে।
প্রেম যেখানে থাকে সেখানে ভয়ও থাকে, ভয় লজ্জা দ্বিধা না থাকলে প্রেম ঠিক প্রেম বলে মনে হয় না। অবাধ প্রেম কোন নর-নারীকেই আকর্ষণ করে না। প্রেমের এই ভয়, না পাওয়ার ভীতি এসব নিয়ে মজনূন যেন সর্বদা চিন্তিত থাকত। কোথাকার কোন হিন্দুস্তানের যুবক সে, তার কাছে কেন আফগান কুমারী বিয়ে দেবেন রাজা! এসব প্রশ্নের কেবল একটাই জবাব দিত শবনম, “আমার কাছে ওষুধ আছে” ।
কি দাওয়াই ছিল শবনমের কাছে যা চিন্তামুক্ত করে দিবে পরদেশী মজনূকে? সত্যিই কি কোন দাওয়াই ছিল নাকি সব প্রেমিকাই যেমন বলে তারকাছে জাদু আছে শবনমও সেরমকই বলেছিল, এসব প্রশ্নের পাওয়া যাবে উপন্যাস শুরু করার অল্প সময়ের মধ্যেই।
লুকোচুরির এই প্রেমের এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় তারা বিয়ে করবে। বিয়ে হয়। একবার না, দুইবার বিয়ে হয় শবনম ও মজনূনের। দুইবার কেন বিয়ে হল সে ব্যাখ্যা জানার জন্য গোটা উপন্যাস পড়তে হবে না, অর্ধেক পড়লেই জানা যাবে।
আফগান মেয়েদের বিয়ের পরে মাথার জুলফ কেটে দিতে হয়, যাতে করে বোঝা যায় তিনি বিবাহিতা। বাঙলা জুলপি কথাটা জুলফ থেকে এসেছে। ইরান তুরানের কুমারীদের অনেকেই দু গুচ্ছ অলক(চুল) রগ থেকে কানের ডগা অবধি ঝুলিয়ে রাখে। এটাই জুলফ। বিয়ের পরে শবনমের জুলফ কাটা নিয়েও বেশ কিছু চিত্তাকর্ষক সংলাপ রয়েছে উপন্যাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে। বিয়ে হল। বাসর রাতে জামাইকে ঘরে ঢুকতে দেখেই কোনায় কোনায় লুকিয়ে থাকা কনের বান্ধবীরা গেয়ে উঠল,
রুটি খায় নি, দাল খায় নি, খায়নি কভু দই, হাড়-হাভাতে ওই এল রে- খাবে তোরে সই! মরি, হায় রে হায় !



শবনম উপন্যাসে প্রেম পর্ব দেখা হল, বিয়ে পর্ব দেখা হল। পড়তে পড়তে মনে হতেই পারে এই উপন্যাসের তাহলে শেষ অবধি হয়ত শুভ সমাপ্তি। যখন থেকে ভাবতে শুরু করবেন এই উপন্যাসের রয়েছে দারুণ এক হ্যাপি এন্ডিং ঠিক তখন থেকে কয়েক পাতা এগুলোই একটা চিরকুট পাওয়া যাবে।
শবনম লিখেছে, “বাড়িতে থেকো। আমি ফিরব”।
কোথায় গেল শবনম? কেনই বা গেল ? ঠিক কতদিনের জন্য গেল? এসব অনেক জটিল প্রশ্ন। সব প্রশ্নের উত্তর রিভিউতে দিয়ে দেয়া যায় না। এত বড় একটা উপন্যাসের মূল এই অংশটুকু লেখক লিখেছেন অনেক শব্দের বিন্যাসে। যারা ভাল পাঠক তাদেরকে কিছুতেই বই ছেড়ে উঠতে দেবে না, শব্দের মারপ্যাঁচে পড়ে যেতেই হবে।
শবনম ঘরে নেই। বিরহে দিন কাটাচ্ছে মজনূন। কয়েক ঘণ্টা হয়ে গেল শবনম ফেরে নি, দিন হয়ে গেল তাও ফেরে নি শবনম। মাস হয়ে গেলে? শবনম কি ঘরে ফিরবে? কেনই বা এই অন্তর্ধান? এতটা ভালবেসে শেষে কেন চলে যেতে হল? এ বিরহের মানে কি ?
ভিনদেশী যুবক মজনূন কি করবে? কোথায় কোথায় খুঁজবে সে তার স্ত্রী শবনমকে। সেকি তাহলে তার নামের মতই হিমিকা হয়ে সকালের রোদ ওঠার সাথে সাথে শুকিয়ে গেছে? কিন্তু সে যে চিরকুটে লিখেছে, “বাড়িতে থেকো। আমি ফিরব”।
একা একা দিন যাপনে মজনূনের কেবল একটা কথাই মনে পড়ত বারবার। শবনমই তাকে বলেছিল, - আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না।
শবনম বলেছে সে ফিরবে। উপন্যাস যখন প্রায় শেষদিকে, আর মাত্র সাত/ আটটি পাতা বাকী। বইটি হাতে নিয়ে আমি ঝিম দিয়ে বসেছিলাম। আর পড়তে চাইছিলাম না। অনেকটা নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই পড়তে হল। একটা করে লাইন পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম পরের লাইনেই হয়ত লেখা দেখতে পাব শবনম কথা রেখেছে, সে ফিরেছে।
উপন্যাসের পাতা এক সময় শেষ হয়ে যায়, শবনম কি কথা রাখে ? সে কি ফিরে আসে? সে যে বলেছিল, “বাড়িতে থেকো। আমি ফিরব”।




চমৎকার এই উপন্যাসটি পড়া শেষ হয়ে গেলেও এর রেশ রয়ে যাবে অনেকদিন। যখন পড়ছিলাম আমি যেন ভাবছিলাম আমার আশেপাশেই কোথাও আছে শবনম।
পুরো উপন্যাসটি একপ্রকার জাল বিস্তার করে ঘিরে রাখবে পাঠককে যা খুব কম লেখকই করতে পেরেছেন।



জাহিদ অনিক ১০/০৮/২০১৭

SHARE THIS

0 comments: